কিডনি ড্যামেজের ৬ টি লক্ষণ কারণ প্রতিকার ও প্রতিরোধ

ড্যামেজের লক্ষণ নিয়ে আজকের আর্টিকেলটিতে আলোচনা করা হবে। কিডনি আমাদের শরীরের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। শারীরবৃত্তীয় নানা কাজে কিডনির ভূমিকা অপরিহার্য। রক্ত ফিল্টার করা থেকে শুরু করে মূত্র উৎপাদন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, দেহে ইলেক্ট্রোলাইটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নানাবিধ কাজ করে থাকে আমাদের কিডনি।

image

এর একটি ক্ষতিগ্রস্ত বা নষ্ট হলেও অপরটি কাজ করে। কিডনি যেহেতু আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য, তাই এর যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।

সূচিপত্র: কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ

কিডনি ড্যামেজ কী?

আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, কিডনির কাজ মূলত আমাদের রক্ত পরিশোধন এবং মূত্র উৎপাদন করা। কিডনি ড্যামেজ হলো সেই অবস্থা যখন আমাদের কিডনি তার এই স্বাভাবিক কাজটা ঠিকমতো করতে পারে না।

অর্থাৎ কিডনি যখন রক্ত পরিশোধন করে মূত্র উৎপাদনের কাজটি সঠিকভাবে করতে অক্ষম হয়, তখন তাকেই কিডনি ড্যামেজ বলা হয়। নানা কারণে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। আসুন সেগুলো জেনে নেয়া যাক।

কিডনি ড্যামেজের কারণ কি?

নানা কারণে কিডনি ড্যামেজ হতে পারে। অসচেতনতা থেকে শুরু করে শরীরে অন্য কোন রোগের কারণে আমাদের কিডনি তার স্বাভাবিক কাজ করার সক্ষমতা হারাতে পারে। কিডনি ড্যামেজের কারণ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হলো:

১। রক্ত চলাচল হ্রাস পাওয়া: কিডনিতে রক্ত চলাচল কম হলে কিডনি ড্যামেজ হতে পারে। বিভিন্ন কারণে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যেমন: শরীরে পানিঘাটতি হওয়া, রক্তস্বল্পতা, হার্টের সমস্যা থাকা, এছাড়া কোন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও কিডনিতে রক্ত চলাচল হ্রাস পেতে পারে। এবং এটি হতে পারে কিডনি ড্যামেজের কারণ।

২। মূত্রনালীর সমস্যা: মূত্রনালীর সমস্যার ফলে কিডনির উপরে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি মূত্রনালীতে কোন ব্লকেজ (blockage) থাকে (যেমন: কিডনির পাথর) যার ফলে মূত্র সঠিকভাবে নির্গত হতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেখানে ইনফেকশন হতে পারে। এটি কিডনি ড্যামেজে রূপ নিতে পারে।

৩। ইনফেকশন: বিভিন্ন ধরণের ইনফেকশন হতে পারে কিডনি ড্যামেজের কারণ।

৪। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: অ্যাস্পিরিন, আইবুপ্রোফেন, লিথিয়াম ইত্যাদি ওষুধ কিডনির উপরে প্রভাব ফেলতে পারে।

৫। অন্যান্য রোগ: অনেক সময় একটি রোগ আরেকটি রোগের কারণ হয়। উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা থাকলে অনেক সময় তা কিডনি ড্যামেজে ঘটাতে পারে।

৬। জেনেটিক কারণ: অনেক সময় জেনেটিক কারণেও কিডনির সমস্যা হতে পারে।

৭। মাদক ও নেশাদ্রব্য: ধূমপান, মদ্যপান, এবং নানা নেশাদ্রব্য সেবন দেহে ও মনে নানারকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এগুলো কিডনির ড্যামেজও ঘটাতে পারে।

কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ গুলো কি কি?

রোগের সঠিক চিকিৎসার পূর্বশর্ত হলো রোগটি শনাক্ত করতে পারা। কোন রোগের লক্ষণ জানা থাকলে আমরা তা সহজেই আন্দাজ করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারি। তাই কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ সম্পর্কেও আমাদের সঠিক তথ্য জেনে রাখা দরকার। নিচে কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ তুলে ধরা হলো:

১। হাত-পা ফোলা: কিডনি ড্যামেজের একটি লক্ষণ হলো হাত-পা অস্বাভাবিক মাত্রায় ফোলা। কারণ সঠিকভাবে মূত্র নিষ্কাশিত না হতে পারায় শরীরে পানি জমে। এতে হাত-পা ফুলতে পারে। তাই আপনার বা আপনার কোন প্রিয়জনের হাত, পা ইত্যাদি অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠছে কি না সেদিকে লক্ষ রাখুন।

২। প্রস্রাবে অস্বাভাবিকতা: অতিরিক্ত বেশি বা অতিরিক্ত কম প্রস্রাব করা কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ হতে পারে। এমন হতে পারে যে ঘন ঘন বাথরুমে যেতে হচ্ছে, বিশেষত রাতে। প্রস্রাব খুব বেশি বা খুব কম হতে পারে। এগুলো প্রতিদিন হতে থাকলে তা কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ হতে পারে।

৩। চামড়ায় অস্বাভাবিকতা: কিডনি ড্যামেজে আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়া শুষ্ক হতে পারে, চুলকাতে পারে, এছাড়া হলুদ ভাব বা ধূসর বর্ণ ধারণ করতে পারে। তাই নিজের স্কিনের দিকে লক্ষ রাখুন।

৪। ক্লান্তিভাব বা অবসাদ: কিডনির সমস্যা হলে আপনার ক্লান্ত লাগতে পারে। শরীরে শক্তির ঘাটতি অনুভব করতে পারেন। সবসময় শুয়ে-বসে থাকতে ইচ্ছা করতে পারে। কোন কাজে আগ্রহ না পেতে পারেন।

৫। ব্যথা: শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা অনুভব করতে পারেন। যেমন: পিঠে ব্যথা, পাঁজর ও নিতম্বের মাঝামাঝি স্থানে ব্যথা ইত্যাদি।

৬। অন্যান্য: এছাড়া আরও কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ। উদাহরণস্বরূপ: ওজন কমে যাওয়া, বমি বমি ভাব, মাংসপেশীতে টান লাগা, শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া, ঘুমে সমস্যা হওয়া, মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, ক্ষুধামন্দা, খাবারের স্বাদ না পাওয়া ইত্যাদি।

উপরোক্ত লক্ষণগুলি আপনার বা আপনার কোন প্রিয়জনের মধ্যে দেখতে পেলে বিলম্ব না করে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা করতে পারলে এই সমস্যা প্রতিহত করা সম্ভব।

কিডনি ড্যামেজের প্রতিকারে করনীয়

কিডনি ড্যামেজের কোন স্থায়ী চিকিৎসা নেই। তবে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চললে আমরা একে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আসুন তবে জেনে নিই কিডনি ড্যামেজের প্রতিকার হিসেবে আমরা কী কী কাজ করতে পারি:

১। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করা: কিডনি ড্যামেজের প্রতিকার হিসেবে প্রথমেই আমাদের জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা অনেকেই তেমন স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করি না। এই অভ্যাসে পরিবর্তন আনলে তা আমাদের অনেকটাই উপকারে আসবে। আমরা নিম্নোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করে জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটাতে পারি:

  • সুষম খাদ্য গ্রহণ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আপনার শরীরের অবস্থা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য প্রতিদিন গ্রহণ করুন। অতিরিক্ত তেল, চর্বি, লবণ, ভাজাপোড়া ইত্যাদি পরিহার করে চলার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে ডায়েট চার্ট নিতে পারেন।
  • নিয়মিত শরীরচর্চা বা ব্যায়াম করুন। শরীরকে কর্মক্ষম রাখুন। এক্ষেত্রে হাঁটার অভ্যাস করা যেতে পারে। এটা অতি উত্তম ব্যায়াম এবং যেকোন বয়সের মানুষই এটি করতে পারেন আর এতে কোন অতিরিক্ত খরচও হয় না। এছাড়া সাঁতার কাটার অভ্যাস করা যেতে পারে। সাঁতার কাটার সময় আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যায়াম হয় তাই এটি একটি অতি উত্তম শরীরচর্চা। তাছাড়া যোগাসন, শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম, জিমে গিয়ে বিভিন্ন ব্যায়াম করা ইত্যাদি পদ্ধতিতেও আমরা শরীরকে সচল রাখতে পারি।
  • মাদক ও নেশাদ্রব্য পরিহার করার চেষ্টা করুন। কারণ এই দ্রব্যগুলো আমাদের শরীরে নানারকম রোগ সৃষ্টির পাশাপাশি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। তাই এগুলো পরিহার করলে আমরা কিডনি ড্যামেজসহ আরও নানা রোগ থেকে বেঁচে থাকতে পারবো।

২। ওষুধ সেবন: কিডনি ড্যামেজের প্রতিকার করতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ বিভিন্ন ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারেন। চিকিৎসকের দেয়া এসব ওষুধ এই রোগকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তাই সময়মতো ওষুধ সেবন করুন।

৩। ডায়ালাইসিস: অনেক সময় কিডনি তার স্বাভাবিক কাজ করতে ব্যর্থ হলে ডায়ালাইসিসের পরামর্শ দেওয়া হয়। ডায়ালাইসিস শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলো নিষ্কাশন করে রক্তকে পরিশুদ্ধ করে। তাই প্রয়োজন দেখা দিলে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করুন।

৪। নতুন কিডনি স্থাপন: কিডনির কার্যকারিতা যদি একেবারেই হারিয়ে যায় তাহলে অনেক সময় অপারেশন করে নতুন কিডনি স্থাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে নতুন কিডনির সাথে আপনার শরীরের ম্যাচ হতে হবে। ঠিক যেমন রক্ত দেওয়ার সময় রক্তের গ্রুপ ম্যাচ হওয়া লাগে।

উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করে আমরা কিডনি ড্যামেজের প্রতিকার করতে পারি। যদিও সম্পূর্ণ নিরাময় হবে না, তবে এর ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রেখে আমরা অনেকটাই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হবো আশা করা যায়।

কিডনি ড্যামেজ প্রতিরোধ

কিছু সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে আমরা কিডনি ড্যামেজ প্রতিরোধ করতে পারি। যেমন:

আরো পড়ুন: পেঁপে খাওয়ার ১০ টি উপকারিতা এবং ১৩ টি পুষ্টি গুণ

  • দেহের চাহিদা অনুযায়ী সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন।
  • নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
  • শরীরকে সচল ও মজবুত রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করুন।
  • মাদক ও নেশাদ্রব্য যেমন বিড়ি, সিগারেট, মদ ইত্যাদি পরিহার করে চলুন।
  • প্রতিদিন সময়মতো ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।
  • নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করুন।

উপরোক্ত কাজগুলো ঠিকমতো করলে আশা করা যায় আমরা কিডনি ড্যামেজ প্রতিরোধ করে একটি সুস্থ, সুন্দর জীবনযাপন করতে পারবো।

উপসংহার - শেষ কথা

এতোক্ষণ আমরা কিডনি ড্যামেজ কী, কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ, কিডনি ড্যামেজের প্রতিকার ও কিডনি ড্যামেজ প্রতিরোধ করার পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানলাম। আশা করি এই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমরা সবাই এই সমস্যা থেকে নিরাপদ থাকতে সক্ষম হবো।

আর্টিকেলটি পড়ে যদি আপনি উপকৃত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। এতে তাঁরাও সচেতন হতে পারবেন। এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে পড়ে থাকলে অনেক ধন্যবাদ। আপনার ও আপনার পরিবারের জন্য রইলো শুভকামনা। (1214)

Thanks

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
Comment মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আর আইটি ফার্মের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url