বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি - ২ টি রোগ পোকামাকড় ও প্রতিকার
আদা চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। যার মধ্যে বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি অন্যতম। বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি সঠিকভাবে জানলে দ্বিগুণ ফলন পাওয়া সম্ভব। তবে শুধু পদ্ধতি জানলেই হবে না পদ্ধতির পাশাপাশি আদা গাছের রোগ, পোকামাকড় ও এর প্রতিকার সহ কিছু বিষয় আমাদের জানতে হবে।
বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি সম্পর্কিত এই আর্টিকেলটি পড়লে এই সকল বিষয় সম্পর্কে আপনারা একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাবেন। এই আর্টিকেলটি বেশ কয়েকজন কৃষিবিদদের মত অনুসারেও লিখা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে বস্তায় আদা চাষ করলে আপনারা সহজেই আদার খুব ভালো ফলন পাবেন।
সূচিপত্র: বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি ২টি রোগ পোকামাকড় ও প্রতিকার
(নিচের যে অংশ থেকে পড়তে চান ক্লিক করুন)
- আদার জাত কি কি
- আদা চাষের উপযুক্ত সময়
- আদা গাছে কি কি সার দিতে হয়
- বস্তায় আদা চাষের সুবিধা
- বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি
- আদা বীজ সংরক্ষণ
- আদা গাছের ২টি রোগ ও পোকামাকড়
- আদা গাছের রোগের প্রতিকার
- উপসংহার - শেষকথা
আদার জাত কি কি?
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উদ্ভাবিত আদার তিনটি জাত রয়েছে। যথা :
- বারি আদা-১ (এর জীবনকাল ২৭০-৩২০ দিন। গাছের গড় উচ্চতা ৭৯-৮২ সেন্টিমিটার)
- বারি আদা-২ (এর জীবনকাল ৩০০-৩১৫দিন। গাছের গড় উচ্চতা ৯০.৪৯-৮৮.৪০ সেন্টিমিটার)
- বারি আদা-৩ (গাছের গড় উচ্চতা ৭৯.৩০-৭৫.৪০ সেন্টিমিটার)
এগুলো ছাড়াও আদার স্থানীয় জাত রয়েছে। যেমন: খুলনা, রংপুরি, টেঙ্গুরা ইত্যাদি জাতের আদাও বাংলাদেশের চাষ হয়।
আদা চাষের উপযুক্ত সময়, মাটি ও আবহাওয়া
সাধারণত এপ্রিল - মে (চৈত্র - বৈশাখ) মাসে আদা লাগাতে হয়। তবে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আদা লাগানোর উপযুক্ত সময়। অন্য সময় বা মাসে যদি আদা চাষ করা হয় তাহলে অতিরিক্ত বৃষ্টির জন্য আদায় পঁচন ধরে যাবে। তাই চৈত্র মাসে শুরুতে আদা চাষ করতে হবে তাহলে আদাগুলো সুন্দরভাবে জন্মাবে ও ফলন ভালো হবে।
সাধারণত আদা বীজ লাগানোর নয় থেকে দশ মাস পর উঠানোর উপযোগী হয়। অর্থাৎ এপ্রিল বা মে মাসে আদা বীজ রোপন করলে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে তা উত্তোলন করা যায়। গাছের প্রায় সব পাতা শুকিয়ে গেলে কেবল আদা তুলতে হবে এর আগে নয়। প্রতি বস্তায় জাত ভেদে ১ থেকে ২ কেজি আদা পাওয়া যায়।
জৈব পদার্থ মিশ্রিত দোআঁশ মাটি, বেলে দোআঁশ মাটি ও উঁচু জায়গা বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি এর জন্য উপযোগী। যদি বেলে দোআঁশ মাটি না থাকে তাহলে সাধারণ মাটির সাথে সম পরিমাণ বালি মিশিয়ে নিতে হবে। মূলত আদা চাষের জন্য পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে এমন উঁচু জায়গা দরকার।
আদা গাছে কি কি সার দিতে হয়?
আদা চাষাবাদের জন্য আদা গাছে বিভিন্ন ধরনের সার প্রয়োগ করা হয় । যেমন:
- গোবর
- ইউরিয়া সার
- অর্ধ পঁচা মুরগির বিষ্ঠা
- টিএসপি
- এম ও পি
- ডিএপি
বস্তায় আদা চাষের সুবিধা
১, জমিতে আদা চাষের তুলনায় বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতিতে আদা চাষ করলে আগাছা হয় না বললেই চলে। ২, এ পদ্ধতিতে একই মাটিতে বারবার ফসল ফলানো যাবে। ৩, কম জায়গায় অধিক ফলন হয়। ৪, এই পদ্ধতিতে খরচ ও পরিশ্রম দুটোই কম হয়। ৫, বস্তায় আদা চাষ করলে যে কোন জায়গায় এটি রাখা যায়। ছায়াযুক্ত স্থানে থাকলেও যখন রোদ দরকার হয় তখন সহজেই রোদে দেয়া যায়।
৬, অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে সহজেই সরিয়ে রাখা যায়। ৭, বন্যায় ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে না, বন্যা হলে বস্তা সরিয়ে আমরা নিরাপদ জায়গায় রাখতে পারি। ৮, এ পদ্ধতিতে আদা চাষ করলে যদি অধিক ফলন হয় তাহলে আর দেশের বাইরে থেকে আমাদের আদা আমদানি করতে হবে না।
বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি
স্বল্প খরচে অধিক পরিমাণ ফলন এবং লাভের জন্য বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি গ্রহণে অনেকে আগ্রহী। বাড়ির ছাঁদ, বারান্দা, বাড়ির চারপাশে ফাঁকা জায়গা, উঠান, লবণাক্ত এলাকা, পরিত্যক্ত জায়গা যেখানে মানুষের যাতায়াত কম - এই ধরনের জায়গা আদা চাষের জন্য উপযোগী। এক মাটিতে একাধিকবার চাষ করা যায় এবং উৎপাদন খরচ খুবই কম।
আপনি যদি প্রতি বস্তায় ২০ থেকে ৩০ টাকা খরচ করেন তাহলে তা থেকে ১ বা ২ কেজি আদা পেতে পারেন। জমিতে আদা চাষ করলে সাধারণত এতটা লাভবান হওয়া যায় না।
বস্তায় আদা চাষের জন্য প্রথমে আমাদেরকে নির্ধারণ করতে হবে যে, আপনি সিমেন্টের বস্তায় আদা চাষ করবেন নাকি জিও ব্যাগে চাষ করবেন। জিও ব্যাগ হল এক বিশেষ ধরণের ব্যাগ যা দেখতে অনেকটা বস্তার মত এবং তা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। সিমেন্টের বস্তা ও জিও ব্যাগে আদা চাষ করার পদ্ধতি একই।
বস্তায় মাটি তৈরি করার উপকরণ:
প্রতি বস্তার জন্য ১০ থেকে ১২ কেজি মাটি, ৫ কেজি পঁচা গোবর, ২ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট, ২০ গ্রাম টিএসপি, ১ কেজি ছাই, এমওপি বা পটাশ ৮ গ্রাম, ১০ গ্রাম দানাদার কীটনাশক, ৫ গ্রাম জিংক, ৫ গ্রাম বোরণ হারে আদারোপনের কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্বে সম্পূর্ণ উপাদান অর্থাৎ গোবর, মাটি ভার্মি কম্পোস্ট, ছাই, রাসায়নিক সার ইত্যাদি ১৫ থেকে ২০ দিন পূর্বে একত্রে মিশিয়ে নিতে হবে। মেশানোর পর এগুলোকে পালা বা ডিবি করে পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে যাতে বাতাস ভেতরে না প্রবেশ করে।
বস্তায় মাটি ভরানো ও বস্তা সাজানো বা স্থাপন করা: বস্তায় মাটি ভরাট করার পূর্বে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে বস্তার উপরের অংশে এক থেকে দুই ইঞ্চি জায়গা যাতে ফাঁকা থাকে। বস্তায় মাটি ভরাট করে রাখার পরে বস্তাগুলো সুন্দরভাবে ৩ মিটার চওড়া অথবা সুবিধামতো প্রস্থ নিয়ে বেড তৈরি করে নিতে হবে এবং সারি সারি করে বস্তা গুলোকে সাজাতে হবে।
একটি বেড থেকে অন্য একটি বেডের মাঝখানে ৬০ সে: মি: ড্রেন রাখতে হবে। বৃষ্টি বা কোন কারনে যাতে পানি জঁমাট বেঁধে না থাকে সেজন্য ড্রেনের মাটি দিয়ে বেড উঁচু করে রাখতে হবে।
বস্তা সাজানোর সময় একটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে তা হল ২টি বস্তার মাঝখানে এমন ভাবে জায়গা রাখতে হবে যাতে করে আপনি সহজেই চলাফেরা করতে পারেন। এতে করে গাছের পরিচর্যা ও স্প্রে করতে আপনার অনেক সুবিধা হবে।
বীজ শোধন: বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি তে আদা বীজ রোপণের পূর্বে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ শোধন করার জন্য ২ গ্রাম থ্রিরাম(৩৭.৫%)+কারবোক্সিন(৩৭.৫%) গ্রুপের প্রোভেক্স প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে এক কেজি আদা বীজ এক ঘন্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর ভেজা আদা পানি থেকে তুলে ছায়ায় শুকাতে হবে। শুকানোর পর তা বস্তায় রোপণের উপযোগী হয়।
বস্তায় আদা রোপন ও বীজের সাইজ: বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি তে আদা চাষ করতে প্রতিটি বস্তায় ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম সাইজের একটি আদা রোপন করতে তে হবে। বীজ বা আদা টি তিন থেকে চার ইঞ্চি মাটির গভীরে লাগাতে হবে এবং লাগানোর পরে তা মাটি দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি: আদা রোপনের ৫০ দিন পর ১০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫ গ্রাম ডিএপি সার প্রতি বস্তায় দিতে হবে। গাছের বয়স ৬৫ দিন হলে প্রত্যেক বস্তায় আবারো দুই থেকে তিন গ্রাম হারে ডিএপি সার দিতে হবে। গাছের বয়স ৮০ দিনের সময় প্রতি বস্তায় পাঁচ গ্রাম হারে ইউরিয়া ও চারগ্রাম এমওপি সার একসাথে দিতে হবে এবং গাছের বয়স ১১০ দিন হলে তখন প্রত্যেক বস্তায় ৩ গ্রাম এমওপি সার ৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫ গ্রাম ডিএপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
আন্ত:পরিচর্যা, বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতি তে অন্যতম একটি সুবিধা হল এতে আগাছা তেমন একটা হয় না। আর হলেও তা নিড়ানি দিয়ে সহজেই পরিষ্কার করা যায়। বস্তায় মাটি যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে সেই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে এবং সার দেয়ার সময় মাটি আলগা করে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে ও গাছের গোড়া থেকে দূরে সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মেশাতে হবে।
সেচ পদ্ধতি: বৃষ্টির মৌসুমে সাধারণত সেচ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।তবে বৃষ্টি না হলে এবং মাটিতে রসের অভাব হলে ঝাঝরি দিয়ে হালকা ভাবে পানি দিতে হবে। পানি যাতে জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আদা বীজ সংরক্ষণ
ছায়াযুক্ত স্থানে মাটির নিচে গর্ত করে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। মাটির নিচে গর্ত করে এক ইঞ্চি পরিমাণ বালু দিয়ে আদা বীজ রেখে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এতে করে আদা বীজ শুকাবে না, এর ওজন কমবে না এবং ভালো থাকবে।
আদা গাছের ২টি রোগ ও পোকামাকড়
রাইজোম রট রোগ: পিথিয়াম এফানিডারমেটাম নামক ছত্রাকের আক্রমণে রাইজোম রট রোগ হয়।এ রোগের কারণে আদা বড় হতে পারে না এবং গাছ মরে যায়। এ রোগে পাতা প্রথমে হলুদ হয় কিন্তু কোন দাগ থাকে না। একসময় গাছ ঢলে পরে এবং শুকিয়ে মারা যায়। রাইজোম(আদা) পঁচে যায়, ফলন বেশি হয় না। আক্রান্ত রাইজম থেকে এক ধরনের গন্ধ বের হয়।সাধারণত বর্ষাকালে বা জলাবদ্ধতার কারণে এই রোগ হয়ে থাকে।
পাতার রোগ: এ রোগে প্রথমে পাতায় ফ্যাকাসে হলুদ বর্ণের দাগ পড়ে। দাগ গুলোর মধ্যে আবার ধূসর রঙ হয় এবং চারদিকে আগামী রং এর আবরণ থাকে। রোগের প্রকোপ বেশি হলে বড় হতে থাকে এবং একত্রিত হতে থাকে।
পোকামাকড়: পাতা খেকো পোকা বাড়ন্ত গাছের পাতা খেয়ে ফেলে পাতার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে ফলে সালোকসংশ্লেষণ ব্যাহত হয়। এতে আদার ফলন কমে যায়।
আদা গাছের রোগের প্রতিকার
রাইজোম রট
- আক্রান্ত গাছ রাইজম সহ সম্পূর্ণরূপে তুলে ফেলা
- আদা বীজ রোপনের পূর্বে বীজকে শোধন করে নেয়া
- সুষম সার ব্যবহার করা
পাতার ঝলসানো রোগ
- রোগ ও পোকামুক্ত ভালো মানের বীজ ব্যবহার করা
- এক লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম ডাইথেন এম৪৫ মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার করে স্প্রে করতে হবে।
পোকামাকড়
পোকামাকড়ের উপদ্রব বেশি হলে এই পোকা দমনের জন্য ১০ দিন পর পর দুই তিনবার করে ০.৫% হারে মার্শাল প্রতি লিটার হারে ডাস্টর্বান গ্রুপের ঔষুধ স্প্রে করতে হবে।
উপসংহার - শেষ কথা
আদা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা জাতীয় ফসল। বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে আদার চাষ না হওয়ায় চড়া দামে বিদেশ থেকে আদা আমদানি করতে হয়। আর এক্ষেত্রে বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি তে আদা চাষ করে আমরা আমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারি এবং আমরা সমৃদ্ধি লাভ করতে পারি। (1219)
ধন্যবাদ-Thanks
আর আইটি ফার্মের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url